সমস্ত লেখাগুলি

গুমনামী বাবা এবং নেতাজি সুভাষ বোসের যোগস্থাপন ~ তথ্যের মিথ্যাচার -
সঞ্জয় উবাচ
Nov. 26, 2024 | রাজনীতি | views:282 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বাঙালি তথা আপামর ভারতবাসীর অবিসংবাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসু। দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের অগ্রগণ্য সেনানী আমাদের প্রাণের নেতাজি। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অহিংস নীতির বিরোধিতা করে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বিরোধী দেশগুলির সাহায্যে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মশাল জ্বেলে দিয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালের ১৮ই অগাস্ট তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনায় ওঁর মৃত্যুর খবর এখনও কোনও বাঙালি বিশ্বাস করতে চায় না। আমাদের মনের মণিকোঠার বীর যেন আক্ষরিক অর্থে অমর।


প্রায় ৭৫ বছর পরেও বাঙালীর মনের মনিকোঠায় বীর সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে তৈরি হওয়া কল্পকাহিনী আরও নতুন নতুন আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়েছে। 


অন্তর্ধান রহস্য সমাধানে - 

৩০শে অগাস্ট ১৯৪৫ জাপানের আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পরেই এডমিরল মাউন্টব্যাটেন জেনারেল ম্যাকআর্থরর্কে নেতাজির মৃত্যুর তদন্তের যে নির্দেশ দেন- তার রিপোর্টেও বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বই সামনে এসেছে। স্বাধীন ভারতে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে গঠিত তিনটি কমিশনের দু’টিতে (শাহনাওয়াজ ও খোসলা কমিশন ) বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্য হয়েছে বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। নেতাজি পরিবারও এই দূর্ঘটনার সত্যতা মেনে নিয়েছিলেন। দুর্ঘটনা কবলিত সেই বিমানের চালক, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সদের সাক্ষ্যের সাথে নেতাজির সঙ্গী ও দেহরক্ষী হাবিবুর রহমান ও দোভাষী নাকামুরার ভাষ্য বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বকেই স্বীকৃতি দেয়।


নেতাজির মৃত্যুরহস্য এবং সন্ন্যাসযোগ - 

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের প্রায় ৫০ বছর পর ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী জাস্টিস মনোজ মুখার্জি কমিশন গঠন করেন। দীর্ঘ এত বছর পরে তথ্যপ্রমাণ এবং সাক্ষীদের অনেকেই জীবিত না থাকার দরুন কমিশনের রিপোর্ট কখনই ত্রুটিহীন হবে না। 


নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের তদন্তে গঠিত মুখার্জী কমিশনে মৃত্যুর ০৫ টি কারণ নথিভুক্ত করা হয়েছে। 


১. লালকেল্লায় গুপ্তহত্যা

২. তাইহোকু বিমান বন্দরে দুর্ঘটনা

৩. ফৈজাবাদের গুমনামী বাবা

৪. শোলমারি আশ্রমের সারদানন্দ

৫. মধ্যপ্রদেশের গুহাবাসী সাধু


এই লেখার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র গুমনামী বাবা ও নেতাজির মিসিং লিঙ্কের সন্ধান। 


মুখার্জী কমিশনের গৃহীত সাক্ষ্য অনুযায়ী নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের সাথে তিনজন সাধুর যোগ স্থাপন করা হয়েছে। 


পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের ফালাকাটা এলাকার শোলমারিতে সারদানন্দ নামে এক সন্ন্যাসীকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছদ্মবেশী রূপ বলে প্রচার পায়। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই প্রচারের অসারতা প্রমাণিত হয়। সারদানন্দ সাতের দশকে শোলমারি ছেড়ে দেরাদুন চলে যান৷ কয়েক বছর পরে সেখানেই দেহ রাখেন৷ 


এরপর নেতাজির আত্মগোপনের খবর প্রকাশ পেল উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ শহরে। ১৯৮৫ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর ফৈজাবাদ শহরের রামভবন থেকে একজন আত্মগোপনকারী সাধু নিখোজ হয়ে যান। এই রামভবনেই ছিলেন গুমনামী বাবা ওরফে মৌনি বাবা ওরফে ক্যাপ্টেন বাবা ওরফে ভগবানজী। 


লোকশ্রুতি অনুযায়ী, গুমনামী বাবা সব সময় নিজেকে পর্দার আড়ালেই রাখতেন। তিনি বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন। দামি পাইপে ধুমপান করতেন। কলকাতা থেকে বাঙালী ভক্তরা প্রায়শই আসতেন এঁর সাথে দেখা করতে। 


গুমনামী বাবার অন্তর্ধানের পরে তার ঘরে নেতাজির পরিবারের ছবি, দামি ঘড়ি, পাইপ, বাংলা বই ও প্রচুর চিঠিপত্র পাওয়া যায়। নেতাজির ভাইজি ললিতা বসু দাবি করেন গুমনামী বাবাই সুভাষচন্দ্র বসু এবং উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এর তদন্ত অনুরোধ করেন। জাস্টিস দেশাই এর তত্বাবধানে গঠিত তদন্ত কমিশন সঠিক তথ্য এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষীর অভাবে গুমনামী বাবাকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র হিসাবে প্রমাণিত করতে পারেনি।


মুখার্জি কমিশনের ১১৪- ১২২ পাতা ধরে গুমনামী বাবা ও নেতাজির মধ্যে মিল স্থাপনের চেষ্টা করলেও গুমনামী বাবার হাতের লেখার নমুনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়৷ বেসরকারি বিশেষজ্ঞ সেগুলি নেতাজির হস্তলিপি বললেও সরকারি পরীক্ষাগারের অভিমত নেতিবাচক৷ বাবার রেখে যাওয়া পাঁচটি দাঁতের ডিএনএ পরীক্ষার ফলও নেতিবাচক বেরিয়েছিল৷ 

হাতের লেখা ও দাতের ডিএনএ টেস্ট রিপোর্টে গুমনামী বাবার সুভাষ চন্দ্র বসু হয়ে ওঠা হল না। 


এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, জাস্টিস মনোজ মুখার্জি কমিশন এবং জাস্টিস বিষ্ণু সাহাই কমিশন আত্মগোপনকারী সাধুকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু হিসাবে স্বীকৃতি দেননি। 


খুনের আসামীর যোগ - 

গুমনামী বাবা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর ৮ই নভেম্বর ১৯৮৫ এ হিন্দি দৈনিক 'অমৃত প্রভাত' এবং 'জনমোর্চা' প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায় যে, ১৯৫৮ সালে কে.ডি উপাধ্যায় ওরফে ক্যাপ্টেন বাবা পণ্ডিত ব্রম্মদেব শাস্ত্রীকে হত্যা করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। লোকশ্রুতি অনুযায়ী কেডি উপাধ্যায় কিছুদিন নেপালে আত্মগোপন করার পর উত্তরপ্রদেশের বস্তি এলাকায় ছিলেন। গুমনামী বাবা ও বস্তি এলাকা থেকেই ফৈজাবাদে এসেছিলেন। কেডি উপাধ্যায় এবং গুমনামী বাবার মিসিং লিঙ্ক শেঠ ঈশ্বরদাস বেণীপ্রসাদ। 


ব্রম্মদেব শাস্ত্রীর ভাই সূর্যনারায়ন মিশ্রার আত্মজীবনীতে শেঠ ঈশ্বরদাস বেণীপ্রসাদের উল্লেখ আছে - কেডি উপাধ্যায়ের স্কুলের অন্যতম আর্থিক সহায়তাকারী হিসাবে। অপরদিকে গুমনামী বাবার অন্যতম ভক্ত ডক্টর আর.পি.মিশ্রার কথায় শেঠ ঈশ্বরদাস বেণী প্রসাদ গুমনামী বাবার প্রকৃত পৃষ্টপোষক ছিলেন। 


তাহলে আত্মগোপন করে থাকা গুমনামী বাবা আসলে একজন পুলিশের খাতায় ফেরার আসামি। এই ঘটনা সত্যি হলে যে বা যারা একজন খুনের আসামীকে ভারতের বীর সন্তান নেতাজির নাম যুক্ত করতে চাইছেন তারা একপ্রকার অপরাধ করছেন।


গুমনামী বাবার RSS সখ্যতা -

জয়বাবা ফেলুনাথ গল্পে হরিদ্বার ঘাটে মছ্লিবাবাকে সাজিয়ে জনসাধারণের সামনে এনেছিলেন দুর্ধষ মগনলাল মেঘরাজ। রামভবনে গুমনামী বাবার মাহাত্য প্রচারের প্রতিটা অধ্যায় যুক্ত করেন বিজেপি নেতারা। 


স্বাধীন ভারতবর্ষের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সাম্প্রদায়িক বিতর্কের কালো অধ্যায়ের যোগ রয়েছে ফৈজাবাদের এই রামভবনের সাথে অযোধ্যার বাবরি মসজিদে রামলালামূর্তি স্থাপন করেন রামভবন -এর গুরুদত্ত সিং।


গুরুদত্ত সিং -এর পৌত্র ঠাকুর শক্তি সিং বর্তমানে BJP নেতা এবং জাস্টিস সহায় কমিশনে পিটিশনে দাবি করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গুমনামী বাবার ছদ্মবেশে রামভবনে আত্মগোপন করেছিলেন।


গুমনামী বাবার ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া RSS এর সংঘচালক গোলওয়ালকারের লেখা চিঠি গুমনামী বাবার সাথে RSS এর যোগ স্পষ্ট করে দেয়। 


অনুমান করা যেতেই পারে যে, রামভবনের ছাদে গেরুয়া পতাকার পালে হাওয়া লাগিয়ে গুমনামী বাবা BJP-RSS এর সযত্নে লালিত হয়েছিল এবং মৃত্যুর পরে তাই নেতাজির মৃত্যু রহস্যে নতুন মোড় এনে দেয়। 


কারণ - 

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুমহাসভার ভূমিকা সর্বদাই ব্রিটিশদের চাটুকারিতা করেই কেটেছে। তাই বিজেপির মেকি জাতীয়তাবোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সারির কোনও নেতার অবলম্বন দরকার। ৩০০০ কোটি টাকার স্ট্যাচু তৈরি করে সর্দার প্যাটেলকে পন্ডিত নেহরুর তুলনায় বড় প্রমাণ করার চেষ্টা। 


নেতাজির এই আকস্মিক অন্তর্ধান দেশবাসী আজও মেনে নিতে পারেনি। নেতাজিকে নিয়ে যে বীরগাঁথা আপামর ভারতবাসীর মনের মনিকোঠায় গেঁথে রয়েছে সেই আবেগকে মূলধন করে বিজেপি তার রাজনৈতিক সুবিধা চরিতার্থ করতে চাইছে। বিজেপি ও আর.এস.এস ঘৃণার রাজনীতি দিয়ে পন্ডিত নেহরুকে কালিমালিপ্ত করার লক্ষ্যে অনেকটাই এগিয়ে গেছে।


এরপর এদের লক্ষ্য গান্ধীজি। যারা প্রকাশ্যে জাতির জনকের হত্যাকারীকে পুজো করেন তারা কখনই গান্ধীজির প্রভাবকে স্বীকার করবেন না। 


নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে সাধু ছদ্মবেশে হাজির করানো এবং আজাদ হিন্দ সরকারকে মান্যতা দেওয়ার পিছনে এদের গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। অদূর ভবিষ্যতে দেশের ইতিহাস RSS এর নাগপুর হেড অফিস থেকে ছেপে আসবে - যেখানে লেখা থাকবে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু নন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আর দেশের টাকায় গাঁধীজির ছবি নয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি যেন অনেক বেশি মানানসই হবে। বিজেপির আইটি সেল ফেসবুক আর সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতাজির ছবি সম্বলিত টাকার প্রতিরূপ ছড়িয়ে দিয়েছে। আমরা সাধারন মানুষেরা গান্ধী-নেহরু-বোস এর সম্পর্কের সমীকরণ খুঁজব আর একধরনের আত্মতৃপ্তি লাভ করব বাঙালি হিসাবে।


আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে নেতাজির মতন একজন বীরপুরুষ সাধুর ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকার মতন কাপুরুষতার কাজ কখনই করবেন না। গুমনামী বাবাকে নেতাজির সাথে এক যারা করতে চাইছেন তারা পক্ষান্তরে নেতাজির আদর্শকেই কালিমালিপ্ত করতে চাইছেন।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929